কিছুক্ষন পরে ই আবার ক্লাস শুরু হবে। ভালো লাগুক আর না লাগুক শুরু করতে হবে নতুন করে ত্রিকোনমিতির জাল।
এই সময় টা,বড্ড বাজে লাগে,সৌমকের।
ভাঙা স্কুলের খোলা ড্রেন থেকে দুর্গন্ধ আসতে থাকে,সামনের খোলা মাঠ থেকে ভেসে আসে রোদে পোড়া একটা তিতকুটে গন্ধ,তার সাথে প্রতি ক্লাসে নিয়ম করে কারেন্ট অফ হওয়া, সব কিছু যেন ছেঁকে ধরে তাকে।
সৌমক এই স্কুলের নবনিযুক্ত প্যারা-শিক্ষক।
এই স্কুলের ই ছাত্র ছিল সে।
যেহেতু প্যারা-শিক্ষক,তাই কর্মশিক্ষা সারিশিক্ষা সহ যে কোন বিষয়ের ক্লাস নিতে হয় তাকে । ইতিহাস,ভূগোল,জীবন-বিঞ্জান, গণিত আর বাংলা,সংস্কৃত,ইংরেজি সব।
নিজে সৌমক, বটানির ছাত্র ছিল, না গাছ পালা ভালোবাসে বলে নয়। আসলে অন্য বিষয় নিয়ে পড়ার মতন নম্বর ছিল না তাই।
আজকে ক্লাস টেনে ইতিহাস পড়িয়ে, এখন ক্লাস টুয়েলভের ফিজিক্স পড়াতে ঢুকতে হবে।
এই স্কুলের ম্যানেজিং কমেটি তে কোনরকমে পয়সা কড়ি দিয়ে,রাজনৈতিক দলে সারা জীবনের মতন দাস খত লিখিয়ে,তার পর ঢুকতে পেরেছে,প্যারা শিক্ষকতায়।
ছাত্ররা অবশ্য প্যারা টিচার বলে কোন আলাদা কিছু ভাবে না,তাদের এই রকম জ্যাক-ক্যালিস মার্কা প্রোফাইল বেশ ভালই লাগে।
ক্লাসে আজকের বিষয় মধ্যাকর্ষণ। যদি ও এই বিষয় টি,না ছাত্রাবস্থায় ঠিক মতন বুঝতে পারতো সৌমক,না এখন বুঝতে পারে। শুধু ম্যানেজিং কমিটির চোখে গ্যারি-সোবার্স হতে হবে,আর কিচ্ছু চাই না। কয়েক বছরের মাথায়, এলাকায় একটু নাম ডাক,বাড়িতে প্রাইভেট টিউশানির একটা বড় ব্যাচ,ব্যাস আর কিস্যু দরকার নেই।
বাড়ি তে সবাই খুব খুশি।
রোল-কল টা নিয়েই, ক্লাস শুরু করল সৌমক।
"যারা যারা পদার্থবিদ্যার বই আনো নি আজ ক্লাসে, তারা বেড়িয়ে যাও ক্লাস থেকে,আমার ক্লাসে তোমাদের থাকার দরকার নেই"। এটা একটা খুব ভাল ষ্ট্রাটেজি,অনেক সময়,ক্লাসের সবচেয়ে প্রশ্ন বেশি করা ছেলে গুলো তা তে বেড়িয়ে যায়।
যে ছেলে গুলো পড়াশুনার একদম শুরুর দিকে থাকে,তাদের নিয়ে চিন্তা নেই। তাদের মনে কোন প্রশ্ন ও থাকে না,তারা প্রশ্ন করতে ও চায় না। সমস্যা শুধু ঐ মার্কা মারা কিছু গবেট দের নিয়েই,সমস্ত ব্যাপারে তাদের প্রশ্ন করা চাই....এত জেনে হবে টা কি?? ভারি বিরক্ত লাগে সৌমকের। কিন্তু কি করা যাবে?? এই পদে আসার জন্য তো কম টাকা দিতে হয় নি ম্যানেজমেন্ট কে...ইচ্ছে করে ঐ ছেলে গুলোর কান ধরে বলতে যে অভিকর্ষর মানে এক বেকার ছেলের বাড়ি থেকে ছিনিয়ে নেওয়া ঐ অত্ত গুলো টাকা।
হঠাৎ দেখা গেল,স্কুলের গেট দিয়ে ঢুকছেন,স্কুলের পদার্থ বিদ্যার আসল শিক্ষক মহিতোষ বাবু। এনার অনুপস্থিতি তেই ক্লাস টি সৌমক নিচ্ছিল। বাব্বাঃ দেখে বুকে ভরসা পেলো সৌমক। এখনো কোন বাঁদর প্রশ্ন শুরু করে নি,তাই বাঁচোয়া। মহিতোষ বাবু তার কাপড়ের বড় দোকান সামলে তবে স্কুলে আসেন,খুব বিঞ্জ মানুষ। উনি এলে আর কেউ প্রশ্ন করতে পারে না।
ঘরে মহিতোষ বাবু ঢুকেই, একগাল শুকনো হাসি হাসলেন,সৌমকের দিকে তাকিয়ে সৌমক ক্লাস থেকে বেড়িয়ে গেল।
কানে এলো কিছু ছাত্রের টিটকিরি," শচীন এসেছে বস্, নেহেরা পালাচ্ছে" কেউ বলল,"অর্জুন এসেছে,ভাই মেকি টা পালাচ্ছে"। আজকাল টিটকিরি গুলো গা সওয়া হয়ে গেছে। বেচারা ছাত্ররা। ওরা জানে না কুরুক্ষেত্র র সকল কিছুর জন্যে যেমন কেবলমাত্র কৃষ্ণ দায়ী, জীবনের এই যুদ্ধে ও কেবলমাত্র ঐ টাকার নোট গুলো দায়ী।
যে ছাত্র গুলোকে,ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছিল,তারা বেশ বিঞ্জ বিঞ্জ ভাব করে আবার ক্লাসে ঢুকলো। আজ মনে হয় কাপড়ের বিক্রী বেশ ভালই হয়েছে, তা না হলে মহিতোষ বাবুর মেজাজ এত ভাল কি করে হতো??
আবার সেই টিটকুটে গন্ধ টা নাকে আসে সৌমকের। বিকেল বেলায় একবার, ঐ ম্যানেজিং কমেটির কাছে হাজিরার খাতা দিয়ে,লাইব্রেরি তে তালা দিয়ে তারপর বাড়ি যেতে হবে।
অনেক দিন আগে পড়া,পথের পাঁচালির অপু র কথা মনে পড়ে। কর্ণ ছিল তার প্রিয় চরিত্র।
সৌমকের কাছে অনেক বেশি প্রিয় বার্বরিক কুরূক্ষেত্রর যুদ্ধে সে অংশ নেয় নি,কারন তার সামনে কেউ টিকে থাকতে পারতো না বলে।
মহাবলি বার্বরিক ছিলেন ঘটোৎকচের পুত্র।
স্বয়ং কৃষ্ণ তার শক্তির পরিচয় পেয়ে তাকে শুধু যুদ্ধে আসতে বারন করেছিলেন তাই না,তার কাছ থেকে তার নিজের মাথা টি চেয়েছিলেন। মহাবলি বার্বরিক নিজে হাতে তার মাথা কেটে,কৃষ্ণ কে ভেট দেন। বার্বরিকের কাটা মাথা,পাহাড়ের উপর থেকে,মহাযুদ্ধ র পুরোটা দেখে।
মহাভারতে এই গল্প টা আর ও অনেক টা আছে, কিন্তু আজ থেকে হাজার বছর আগে,কোন অঞ্জাত লেখক,বার্বরিকের চরিত্র টা কেন লিখেছিলেন মহাভারতে,সে টা কেউ জানতে পারবে না।
মহাবির হয়ে ও বার্বরিক যুদ্ধে অংশ নেন নি। নিজের হাতে মাথা কেটে দিয়ে,সবার টিটকিরি র পাত্র হয়ে,এক নির্জন পাহাড়ের ওপর থেকে,যুদ্ধ দেখে গেছে।
যুদ্ধর পরে ভিষ্ম,ভীম,অর্জুন সবাই খ্যাতিলাভ করেছে,বার্বরিক থেকে গেছে,তথাকথিত বর্বর দের প্রচলিত গল্পে, রাজস্থানে, "খাটু শ্যাম জি" হিসেবে।
.....মহিতোষ বাবু এই বেরিয়ে গেলেন, স্কুল এক্ষুনি ছুটি হবে। তিতকুটে গন্ধ টা একটা নতুন ভাবনা র জন্ম দিল,সৌমকের মনে। গন্ধ টা কি বার্বরিকের কাটা গলার থেকে আসছে??
ঠিক তক্ষুনি ম্যানেজিং কমেটির সভাপতি সাইকেল নিয়ে স্কুলে ঢুকলেন।
====================================